
আখেরি চাহার সোম্বা মূলত মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত একটি বিশেষ দিন, যা মহররম মাসের শেষ বুধবার বা সফর মাসের শেষ বুধবারে পালন করা হয়। এটি বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের মধ্যে বেশি প্রচলিত।
এটি পালন করার পেছনে মূলত একটি বিশ্বাস কাজ করে, যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের একটি ঘটনার সাথে সম্পর্কিত। তবে এখানে লক্ষ্যণীয় যে, এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ আছে। আমি নিচে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করছি।
আখেরি চাহার সোম্বা কী>
“আখেরি” মানে শেষ, “চাহার” মানে চার, “সোম্বা/শোম্বা” মানে বুধবার। অর্থাৎ, আখেরি চাহার সোম্বা বলতে বোঝায় সফর মাসের শেষ বুধবার। এই দিনে মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ আমল, দোয়া ও নফল নামাজ আদায় করে থাকেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট>
মুসলিম ঐতিহ্যে প্রচলিত একটি বর্ণনা অনুযায়ী: রাসূলুল্লাহ ﷺ জীবনের শেষ অসুস্থতার সময় কয়েকদিন কঠিন জ্বরে ভুগছিলেন। পরে তিনি যে দিনে কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেন এবং ঘর থেকে বের হয়ে সাহাবিদের সাথে কথা বলেন, সেটি ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার।
তাই কিছু মানুষ মনে করেন, এ দিনটি ছিল রাসূল ﷺ-এর সুস্থতার দিন, ফলে তারা দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করেন।
তবে অনেক হাদিস বিশারদ ও ইসলামী পণ্ডিতের মতে, এই ঘটনা দুর্বল বর্ণনার উপর ভিত্তি করে এবং সুনির্দিষ্টভাবে শেষ বুধবারের কোনো প্রমাণ সহিহ হাদিসে নেই।
পালন পদ্ধতি>
যারা পালন করেন, তারা সাধারণত নিচের আমলগুলো করে থাকেন: নফল নামাজ আদায় – কেউ কেউ ২ রাকাত বা ৪ রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। দোয়া পাঠ – বিশেষ দোয়া, যেমন “আখেরি চাহার সোম্বার দোয়া” পড়ে থাকেন। দান-সদকা – অনেকেই এদিন গরিবদের মধ্যে খাবার বা অর্থ বিতরণ করেন। কোরআন তেলাওয়াত ও ইস্তিগফার – ক্ষমা প্রার্থনা ও কল্যাণ কামনা করা হয়।
পালনের পেছনে বিশ্বাস>
যারা আখেরি চাহার সোম্বা পালন করেন, তারা সাধারণত বিশ্বাস করেন: এ দিনে রাসূল ﷺ সুস্থ হয়েছিলেন। এই দিনে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য রহমতের দরজা উন্মুক্ত করেন। দিনটি বালা-মুসিবত থেকে মুক্তির একটি সুযোগ।
ইসলামী আলেমদের মতভেদ>
আখেরি চাহার সোম্বা নিয়ে দুই ধরনের মত আছে: ১. যারা পালন সমর্থন করেন, তারা বলেন, যেহেতু রাসূল ﷺ সুস্থ হয়েছিলেন, দিনটি বরকতময়।, নফল ইবাদত করা কোনোভাবেই নিষিদ্ধ নয়।, আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা ও বিপদ থেকে রক্ষার দোয়া করা সবসময়ই উত্তম।
২. যারা বিরোধিতা করেন: অনেক আলেম, বিশেষ করে সালাফি ও দেওবন্দি মতের আলেমরা বলেন, সহিহ হাদিসে কোথাও “আখেরি চাহার সোম্বা” পালন করার প্রমাণ নেই। নির্দিষ্ট দিনকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া বিদআত। রাসূল ﷺ কখনো এ দিনের কোনো বিশেষ আমল করেননি। বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলন, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে এ দিনের বিশেষ নামাজ, দোয়া ও মিলাদ অনুষ্ঠিত হয়। অনেক জায়গায় মসজিদ ও ঘরে সমবেত দোয়া হয়। তবে সব মুসলমানই এটি পালন করেন না; একে সাংস্কৃতিক ধর্মীয় প্রথা হিসেবে দেখা হয়।
সারসংক্ষেপ>
বিষয়বিবরণকবে পালন হয়সফর মাসের শেষ বুধবারমূল বিশ্বাসএ দিনে রাসূল ﷺ কিছুটা সুস্থ হয়েছিলেনপ্রধান আমলনফল নামাজ, দোয়া, দান-সদকাআলেমদের মতভেদকারও মতে বরকতময় দিন, কারও মতে বিদআতপ্রচলন অঞ্চলবাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, কিছু আরব দেশ।
আখেরি চাহার সোম্বার নফল নামাজের পদ্ধতি
১. সময়
সাধারণত সফর মাসের শেষ বুধবার যোহর নামাজের পর এই নফল নামাজ আদায় করা হয়। তবে অনেকে যে কোনো সময়ও আদায় করে থাকেন।
২. নামাজের রাকাত
সাধারণত ৪ রাকাত নফল নামাজ একসাথে আদায় করা হয়।
৩. নিয়ত
“আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমতের জন্য আখেরি চাহার সোম্বার নফল নামাজ আদায় করছি।”
৪. প্রতিটি রাকাতে সূরা পাঠের নিয়ম
নিচের নিয়মটি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অঞ্চলে প্রচলিত:
প্রথম রাকাতে: সূরা ফাতিহার পর ৩ বার সূরা কদর + ৩ বার সূরা ইখলাস
দ্বিতীয় রাকাতে: সূরা ফাতিহার পর ৩ বার সূরা কদর + ৩ বার সূরা ফালাক
তৃতীয় রাকাতে: সূরা ফাতিহার পর ৩ বার সূরা কদর + ৩ বার সূরা নাস
চতুর্থ রাকাতে: সূরা ফাতিহার পর ৩ বার সূরা কদর + ৩ বার আয়াতুল কুরসি
কেউ কেউ শুধু প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ৭ বার সূরা ইখলাস পড়ার নিয়মও অনুসরণ করেন।
৫. নামাজ শেষে দোয়া
নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করা হয়। এখানে প্রচলিত একটি বিশেষ দোয়া রয়েছে।
আখেরি চাহার সোম্বার প্রচলিত দোয়া
আরবি দোয়া:
اللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدٍ وَ عَلٰى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلٰى إِبْرَاهِيمَ وَ عَلٰى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ.
اللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِحَقِّ مُحَمَّدٍ نَبِيِّكَ الْمُصْطَفَى، أَنْ تَكْفِيَنِي شَرَّ كُلِّ بَلَاءٍ وَ وَبَاءٍ وَ مَرَضٍ وَ فَسَادٍ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ.
উচ্চারণ (Transliteration):
Allahumma salli ‘ala Muhammadin wa ‘ala aali Muhammadin kama sallaita ‘ala Ibrahima wa ‘ala aali Ibrahima innaka Hamidum Majid.
Allahumma inni as’aluka bihaqqi Muhammadin nabiyyikal mustafa an takfiyani sharra kulli bala’in wa waba’in wa maradin wa fasaadin fid-dunya wal-akhirah.
অর্থ:
“হে আল্লাহ! প্রিয় নবী মুহাম্মদ ﷺ ও তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, যেমন আপনি ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি রহমত বর্ষণ করেছেন।
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আপনার প্রিয় নবী ﷺ-এর মর্যাদার বরকতে আমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের সব ধরনের বিপদ, রোগ, দুর্যোগ ও ফিতনা থেকে হেফাজত করুন।”
৬. অতিরিক্ত আমল
নামাজ শেষে সূরা ইয়াসিন ১ বার তেলাওয়াত করা।
গরিবদের মধ্যে সদকা বা খাবার বিতরণ করা।
পরিবারের কল্যাণ, সুস্থতা ও বিপদমুক্তির জন্য বিশেষ দোয়া করা।
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
সহিহ হাদিসে “আখেরি চাহার সোম্বা”র কোনো নির্দিষ্ট নামাজ, দোয়া বা আমল নেই। তবে যেহেতু নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া সবসময়ই উত্তম আমল, তাই ইচ্ছা করলে পালন করা যায়। যদি এটি বাধ্যতামূলক, ফরজ বা সুন্নত ভেবে পালন করা হয়, সেটি বিদআত বলে গণ্য হতে পারে।