
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি:
বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী এবং অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহাসিক বাড়িটি ভাঙার ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে। হরিকিশোর রায় সড়কে অবস্থিত প্রায় ২০০ বছর পুরনো ভবনটির একাংশ ভেঙে ফেলেছে জেলা শিশু একাডেমি। এ সিদ্ধান্ত ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ ও সাহিত্যিকরাও।
জেলা শিশু একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলছে, দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভেঙে সেখানে আধুনিক স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও ভবনটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তে বিস্মিত অনেকেই।
ঐতিহ্যবাহী ভবনের ইতিহাস
বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, জমিদার হরিকিশোর রায়ের পোষ্যপুত্র ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। পাঁচ বছর বয়সে তিনি এই পরিবারে আশ্রিত হন এবং এখান থেকেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে তিনি বৃত্তি পেয়ে প্রবেশিকা পাস করেন। এই বাড়িটি ছিল তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত আবাসস্থল, যা পরবর্তীকালে শিশু একাডেমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
ভবন ভাঙার কারণ ও বিতর্ক
জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা মো. মেহেদী জামান জানান, ২০১০ সালের পর ভবনটি ব্যবহারযোগ্য ছিল না। ভাড়া ভবনে মাসে ৪৭ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে, যা সরকারের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য ভবনটি ভেঙে একটি আধাপাকা ভবন নির্মাণের পর সেখানে পাঁচতলা ভবন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ভাঙার কাজটি করছে মেসার্স ময়ূর বিল্ডার্স। শিশু একাডেমির দাবি, গণপূর্ত অধিদপ্তরের পরামর্শ ও অনুমতি নিয়েই ভবনটি ভাঙা হচ্ছে।
তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের একটি ঐতিহাসিক স্থাপনার বিষয়ে যথাযথ পর্যালোচনা ও সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিয়েই ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত। মাঠ কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন লিখিতভাবে শিশু একাডেমির কর্মকর্তার কাছে ভবনের তথ্য চেয়েছেন। তিনি জানান, ভবনটি বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত না হলেও চলতি বছরের জরিপে তা হতে পারে।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
ভবন ভাঙার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ জানিয়ে অনেকে মন্তব্য করেন, ময়মনসিংহ শহরের অতীত ঐতিহ্য ধ্বংসের মুখে। ‘ময়মনসিংহ সিটি’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে আশিক উজ্জামান লেখেন,
“পুরোনো স্থাপনা ময়মনসিংহে আর তেমন কিছুই রইলো না… অথচ এই শহরকে কলকাতার মতো রাজকীয় শহর হিসেবে সাজানো যেত।” এক সময় এই বাড়িতে ক্লাস করা ফাল্গুনি চক্রবর্তী স্মৃতিচারণ করে লেখেন, “শিশু একাডেমির ক্লাস করতাম এখানে।”
লেখক ফয়েজ আহমেদ বলেন, “২০০ বছরের পুরনো ভবনটি সংস্কার করে নতুন ভবন নির্মাণ করা যেত। এটি ভেঙে ফেলা ইতিহাসের প্রতি চরম অবহেলার পরিচায়ক।”
প্রশাসনিক উদ্যোগ
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেজা মো. গোলাম মাসুম প্রধান বলেন, “শিশু একাডেমি কীভাবে ভবনটি ভেঙে কাজ করছে, তা জানতে কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নেওয়া হবে।”
ভারতীয় প্রস্তাব
এদিকে সংবাদ প্রকাশের পর ভারতের পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী এ ভবন সংরক্ষণ ও পুনর্নির্মাণে সহযোগিতার প্রস্তাব এসেছে বলেও জানা গেছে।